দেশ-কাল বিষয়ক তত্ত্ব রচনায় কান্ট দুটি সমস্যার সম্মুখীন –
১) যৌগিক পূর্বত: সিদ্ধ বিধান কিভাবে সম্ভব?
২) দেশ-কালপরিচ্ছেদ রহিত অতীন্দ্রিয় বস্তুর সম্ভাবনা কিভাবে ব্যাখ্যা করা যায়?
দেশ-কাল বিষয়ক নিউটনীয় মতে প্রথম সমস্যার সমাধান মিললেও দ্বিতীয় সমস্যার সমাধান মেলেনি। আর লাইবনিৎসীয় মতে দ্বিতীয় সমস্যার সমাধান পাওয়া গেলেও প্রথম সমস্যার সমাধান মেলেনি। কান্ট তাঁর দেশ-কাল বিষয়ক মতে একাধারে ওই দু’টি সমস্যারই সমাধান করতে চেয়েছিলেন।
কান্টের মতে দেশ ও কাল পূর্বত: সিদ্ধ অনুভবস্বরূপ। দেশ ও কাল কান্টের মতে অনুভব, শুদ্ধ অনুভব। দেশ ও কাল অনুভব কারণ তারা প্রত্যয় বা সামান্য ধারণা নয়। দেশ ও কাল আমাদের অনুভবেরই অপরিহার্য অংশস্বরূপ।
তাছাড়া কান্ট দেশ-কালের অনুভবকে শুদ্ধ অনুভব বলেছেন কারণ তাদের মধ্যে এমন কিছু নেই যা ইন্দ্রিয় সংবেদনের অন্তর্ভুক্ত। একটি সমগ্র অনুভব বা আভাস থেকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সকল সংবেদন বিচ্ছিন্ন করলে যা অবশিষ্ট থাকে তাই দেশ ও কাল।
দ্বিতীয়ত
দেশ ও কাল চরমভাবে পূর্বত:সিদ্ধ, অর্থাৎ তারা চরমভাবে অভিজ্ঞতানিরপেক্ষ। যা সর্বতোভাবে অভিজ্ঞতানিরপেক্ষ যার অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য কোন ইন্দ্রয় সংবেদনের প্রয়োজন নেই তাই পূর্বত: সিদ্ধ।
যা পূর্বত:সিদ্ধ তা সার্বিক ও অনিবার্য। সার্বিকতা ও অনিবার্যতা পূর্বত: সিদ্ধির দুটি লক্ষণ। কোন কিছু সার্বিক ও অনিবার্য হলে তা পূর্বত: সিদ্ধ। দেশ ও কাল পূর্বতঃ সিদ্ধ কারণ তারা সকল রকম ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা নিরপেক্ষ এবং সকল রকম ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার আবশ্যিক পূর্বশর্ত।
দেশ ও কালরূপ আকারের মধ্য দিয়েই কোন বস্তু অনুভবের বিষয় হতে পারে। অর্থাৎ একটি বস্তু ইন্দ্রিয় অনুভবের বিষয় হয়েছে অথচ দৈশিক ও কালিক আকারে আকারিত হয় নি এমন অসম্ভব।
তাই দেশ ও কাল পূর্বতঃসিদ্ধ এখানে পূর্ববর্তিতা বলতে কালিক পূর্ববর্তিতা বোঝায় না, বোঝায় আবশ্যিক শর্তকে। দেশ ও কাল সকল ইন্দ্রিয় অনুভবের আবশ্যিক শর্ত – এই অর্থেই দেশ ও কাল পূর্বত:সিদ্ধ।
দেশ ও কাল যে পূর্বত:সিদ্ধ অনুভব তা প্রমাণ করার জন্য কান্ট দু’রকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন – আধিবিদ্যক ব্যাখ্যা ও জ্ঞানতাত্বিক ব্যাখ্যা।
কোন ধারণার অন্তর্নিহিত স্বরূপ-বিশ্লেষণের মাধ্যমে ওই ধারণার পূর্বত:সিদ্ধতা প্রদর্শনই হলো আধিবিদ্যক ব্যাখ্যা) আধিবিদ্যক ব্যাখ্যা একথাই প্রমাণ করে যে দেশ ও কালের পূর্বতঃসিদ্ধ হবার ব্যাপারটি তাদের স্বরূপের মধ্যেই নিহিত।
অপরপক্ষে কোন পূর্বতঃসিদ্ধ সংশ্লেষক জ্ঞানের সম্ভবপরতা ব্যাখ্যা করার জন্য দেশ ও কালের পূর্বতঃসিদ্ধতা স্বীকার করাই হলো জ্ঞানতাত্বিক ব্যাখ্যা।
এরকম ব্যাখ্যায় দেখানো হয় যে দেশ ও কালের পূর্বত:সিদ্ধতা স্বীকার না করলে পূর্বত:সিদ্ধ সংশ্লেষক জ্ঞানের সম্ভবপরতা ব্যাখ্যা করা যায় না।
দেশের আধিবিদ্যক ব্যাখ্যা ঃ দেশ-কালের আধিবিদ্যক ব্যাখ্যার অংশ দু’টি। প্রথমটিতে কান্ট দেখিয়েছেন যে, দেশ ও কাল অভিজ্ঞতা নিরপেক্ষ বা পূর্বত:সিদ্ধ । আর দ্বিতীয় অংশে তিনি দেখিয়েছেন যে, দেশ ও কাল বিমূর্ত প্রত্যয় বা সামান্য ধারণা নয়, দেশ ও কাল হলো অনুভব। দু’টি অংশ একত্রে প্রমাণ করে দেশ ও কাল পূর্বত:সিদ্ধ অনুভব।
প্রথম যুক্তি
দেশ বাহ্য অভিজ্ঞাতা থেকে উদ্ভূত বা বিমূর্তকরণ প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত ঐন্দ্রিয়ক প্রত্যয় বা সামান্য ধারণা নয়; কারণ সংবেদনগুলিকে বাইরে বা পাশাপাশি রূপে জানতে হলে, তারা যে বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত তা জানতে হলে দেশকে পূর্ব থেকে স্বীকার করে নিতে হয়।
এই মতের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ একটি মত এই যে, বাহ্যবস্তুর ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ থেকে দেশবোধ উৎপন্ন হয়। সুতরাং দেশ হলো বাহ্য অভিজ্ঞতা জাত সামান্য ধারণা। এই মতানুসারে যখন আমরা বাহ্য পদার্থগুলিকে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে প্রত্যক্ষ করি তখন ‘এখানে-ওখানে’, ‘কাছে-দূরে’, ‘ছোট-বড়’ প্রভৃতি অনুভব হয়ে থাকে। এই সব অনুভব থেকেই দেশবোধ উৎপন্ন হয়।
এই মতের বিরোধিতা করেই কান্ট বলেন যে, আমাদের মনে দেশবোধ আগে থেকে আছে বলেই বাহ্য পদার্থ প্রত্যক্ষের সময় আমরা তাকে দৈশিক ধর্মযুক্তি বলেই প্রত্যক্ষ করে থাকি। সকল রকম ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষের পূর্বে আমাদের মনে দেশবোধ আছে বলেই আমরা কোন কিছু প্রত্যক্ষ করার সময় আমাদের ‘এখানে-ওখানে’, ‘কাছে-দূরে’, ‘ছোট বড়’ প্রভৃতি অনুভব হয়ে থাকে।
দ্বিতীয় যুক্তি
আমরা বস্তুহীন দেশের কথা ভাবতে পারি। কিন্তু আমরা দেশের অনুপস্থিতির কথা ভাবতে পারি না। তাই দেশেকে আভাসের পূর্বশর্ত বলে গণ্য করা যায়। দেশ পূর্বত:সিদ্ধ কারণ দেশ অনিবার্য এবং অনিবার্যতা পূর্বত:সিদ্ধির একটি লক্ষণ। কিন্তু দেশ যে অনিবার্য তা কিভাবে দেখানো যায়? কান্ট বলেন, আমরা বস্তুহীন দেশের কথা ভাবতে পারি।
কিন্তু আমরা দৈশিক ধর্ম বিযুক্ত বস্তুর কথা ভাবতে অক্ষম। দৈশিক ধর্মহীন বিষয়ের কথা ভাবতে গেলে বিষয়ের বিষয়ত্ব থাকে না। কোন কিছুকে জ্ঞানের বিষয় হতে গেলে তাকে দৈশিক ধর্মযুক্ত হতেই হবে।
দৈশিক ধর্মবিযুক্ত বিষয় জ্ঞানের বিষয়ই নয়। কাজেই দেশ বস্তু বা বিষয়-নির্ভর নয়। বরং দেশ আভাসের সম্ভবপরতার আবশ্যিক শর্ত এবং দেশের ধারণা যৌক্তিকভাবে আভাসের পূর্বগামী।
উপরন্তু দৈশিক ধর্মকে অন্যান্য ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ধর্মের সঙ্গে তুলনা করলে সহজেই বোঝা যায় যে কেন দৈশিক ধর্ম অনিবার্য। কোন বস্তুতে কোন বিশেষ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ধর্মের (রূপ, রস, গন্ধ) অভাব আমরা কল্পনা করতে পারি। কিন্তু দৈশিক ধর্মের অভাব বা অনুপস্থিতির কথা আমরা কল্পনাই করতে পারি না। কোন বস্তু জ্ঞাত হয়েছে অথচ তার দৈশিক ধৰ্ম জ্ঞাত হয় নি– এমন অসম্ভব। সুতরাং জ্ঞানিক পরিস্থিতিতে দেশ অনিবার্য এবং সেই হেতু পূর্বত:সিদ্ধ।
তৃতীয় যুক্তি
এই যুক্তির উপপাদ্য – দেশ সামান্য ধারণা নয়, বিশুদ্ধ অনুভব। তার কারণ দু’টি। প্রথমত: আমরা কেবল একটি দেশেরই ধারণা করতে পারি। যখন আমরা বিভিন্ন দেশের কথা বলি তখন আমরা সেগুলিকে একই অনুপম দেশের অংশ বলেই বুঝি। দ্বিতীয়ত: অংশগুলি কখনও এক সর্বব্যাপী দেশের উপাদান হিসেবে পূর্বগামী হতে পারে না। অংশগুলিকে এক সর্বব্যাপী দেশের অন্তর্ভুক্ত বলে চিন্তা করা যায়। দেশ মূলত: এক, দেশের অন্তর্ভুক্ত বহুতা একই দেশের সীমিতকরণের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং একথাই প্রমানিত হয় যে দেশ সংক্রান্ত সকল ধারণার অন্তরালে একটি পূর্বত:সিদ্ধ অনুভব আছে।
এখানেও একটি বিরুদ্ধ মত খন্ডন করেছেন কান্ট। এই বিরুদ্ধ মতানুযায়ী দেশ এমন একটি সামান্য ধারণা যা বিভিন্ন দৈশিক সম্বন্ধ থেকে বিমূর্তকরণ প্রক্রিয়ায় গঠিত। কিন্তু কান্ট এমতের বিরোধিতায় বলেছেন যে পূর্ব থেকে আমাদের মনে এক সর্বব্যাপী সমগ্র দেশের ধারণা আছে বলেই সেই সর্বব্যাপী দেশকে সীমিত করে আমরা খণ্ড খণ্ড দেশের কথা ভাবি। এক অখন্ড ও সর্বব্যাপী দেশের ধারণা কোন সামান্য ধারণা নয়। সুতরাং দেশ অনুভব।
চতুৰ্থ যুক্তি
দেশের আধিবিদ্যক এই চতুর্থ যুক্তিটিতে কান্ট দেশ ও সামান্য ধারণার প্রভেদ দেখিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে দেশ সামান্য ধারণা নয়। কান্টের এই যুক্তিটিকে নিম্নরূপে বিশ্লেষণ করা যায়।
দেশ ও দৈশিকতা সমার্থক নয়। দৈশিকতা একটি সামান্য ধারণা
যা আমরা বিভিন্ন দৈশিক বস্তু থেকে বিমূর্ত্তকরণ প্রক্রিয়ার সাহায্যে গঠন করে থাকি। অন্য যেকোন ধারণা যেমন তার অন্তর্ভুক্ত অসংখ্য ব্যক্তির মধ্যে থাকে, দৈশিকতাও তেমনি অসংখ্য বস্তুর মধ্যে থাকে। অসংখ্য দৈশিক বস্তু, দৈশিকতা সামান্যের অধীন। দৈশিক বস্তুগুলি দৈশিকতার মধ্যে আছে – এমন কথা বলা যায় না। কিন্তু দেশের বেলায় আমরা এরকম ভাবি যে খন্ড দেশগুলি এক অখন্ড অনন্ত দেশের মধ্যে আছে।
ব্যক্তির মধ্য দিয়ে সামান্য ব্যক্ত হয়। ব্যক্তি সামান্যের প্রকাশক। কিন্তু খন্ড খন্ড অসংখ্য দেশের মধ্য দিয়ে অখন্ড অনন্ত দেশ ব্যক্ত হয় – এমন বলা যায় না। বরং এক অখন্ড ও অনন্ত দেশের অস্তিত্ব পূর্ব থেকে স্বীকার না করলে খন্ডিত ও সীমিত দেশের কথা বলা যায় না।
এমনকি সামান্য ও তার অন্তর্ভুক্ত সম্বন্ধ সমগ্র ও অংশের সম্বন্ধ নয়। কিন্তু দেশ ও খন্ড দেশের সম্বন্ধ সমগ্র ও অংশের সম্বন্ধ। এদিক থেকেও দেশ সামান্য ধারণা নয়। সুতরাং দেশ হলো পূর্বতঃসিদ্ধ অনুভব।
দেশের জ্ঞান তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা :
দেশের জ্ঞানতাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় কান্ট বলেছেন যে, কোন কোন ক্ষেত্রে পূর্ব থেকে কোন বিশেষ প্রত্যয়কে নিয়ম হিসেবে স্বীকার না করলে অন্য একটি পূর্বত:সিদ্ধ সংশ্লেষক জ্ঞানের সম্ভবপরতা ব্যাখ্যা করা যায় না। দেশের বেলায় ঠিক এরকমটি ঘটে। দেশকে পূর্বতঃসিদ্ধ অনুভব বলে স্বীকার না করলে জ্যামিতিক জ্ঞানের সম্ভবপরতা ব্যাখ্যা করা যায় না। জ্যামিতি হল সেই শাস্ত্র যা বস্তুর দৈশিক ধর্ম নিয়ে আলোচনা করে। অর্থাৎ জ্যামিতিক বচনগুলি, দেশ সংক্রান্ত বচনগুলি পূর্বত:সিদ্ধ ও সংশ্লেষক।
কিন্তু দেশ যদি সামান্য ধারণা হতো তাহলে দেশ-সংক্রান্ত বচনগুলি বিশ্লেষক হতো, কারণ কোন সামান্য ধারণা থেকে এমন কোন বচন নিষ্কাশন করা যায় না যা ওই সামান্য ধারণাকে অতিক্রম করে যায়। কিন্তু জ্যামিতিক বচন অর্থাৎ দেশ সংক্রান্ত বচন বিশ্লেষক নয়। জ্যামিতিক বচনগুলি ধারণা সংক্রান্ত বচন নয়, বাস্তব জগৎসংক্রান্ত বচন, জ্যামিতিক বচন সমূহ বাস্তব জগতেও প্রযোজ্য। কাজেই দেশ সামান্য ধারণা নয়, দেশ অনুভব। শুধু তাই নয়, দেশ পূর্বত:সিদ্ধ অনুভব। জ্যামিতিক বচনগুলি অপরিহার্য এবং ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষে অপরিহার্যতার জ্ঞান হয় না। কাজেই একথা স্বীকার করে নিতে হয় যে, অভিজ্ঞতা নিরপেক্ষভাবে বা পূর্বত:সিদ্ধভাবে দেশের জ্ঞান হয়। দেশ পূর্বত:সিদ্ধ অনুভব।
কালের আধিবিদ্যক ব্যাখ্যা:
কালের আধিবিদ্যক ব্যাখ্যা কালের আধিবিদ্যক ব্যাখ্যায় কান্টযে যুক্তিগুলি দিয়েছেন তা নিম্নরূপ :
প্রথম যুক্তিঃ
কাল অভিজ্ঞতা থেকে লব্ধ কোন প্রত্যয় নয়। কারণ যৌগপত্য বাপার বা পারম্পর্যের প্রত্যক্ষ সম্ভব হতো না যদি না কালের ধারণা পূর্বত:সিদ্ধ রূপে আমাদের মনে থাকত। কেবল কালের পূর্বস্বীকৃতির উপর ভিত্তি করেই আমরা বস্তুকে যুগপৎ বা আনুপূর্বিক বলে প্রত্যক্ষ করে থাকি।
কালের আধিবিদ্যক ব্যাখ্যায় কান্ট প্রদত্ত এই যুক্তিটির তাৎপর্য এই যে, এখানে তিনি একটি বিরুদ্ধ মতের সমালোচনা করেছেন। অনেকের মতে, আমরা বিভিন্ন ঘটনাকে একই সঙ্গে বা পরপর ঘটতে দেখি এবং সেই অভিজ্ঞতা থেকে কালের ধারণা গঠন করি। সুতরাং কাল হলো অভিজ্ঞতালব্ধ প্রত্যয়। কিন্তু কান্টের মতে যৌগপত্য বা পারম্পর্যের মূলে আছে কালের পূর্বস্বীকৃতি। তাই কাল অভিজ্ঞতালব্ধ প্রত্যয় নয়। বরং জ্ঞানের আকার হিসেবে কালের ধারণা পূর্ব থেকেই মনে থাকে বলে আমরা বিভিন্ন ঘটনাকে যুগপৎ বা আনুপূর্বিক বলে প্রত্যক্ষ করতে পারি। সুতরাং কাল পূর্বত:সিদ্ধ।
দ্বিতীয় যুক্তি :
কাল এমন একটি অপরিহার্য ধারণা যা সকল ইন্দ্রিয় অনুভবের ভিত্তি স্বরূপ। আভাসের ক্ষেত্রে আমরা কালকে বাদ দিতে পারি না, যদিও আমরা কালকে আভাসশূন্য বলে ভাবতে পারি সুতরাং কাল পূর্বত:সিদ্ধ।
কান্ট-প্রদত্ত যুক্তিটিকে নিম্নোক্তভাবে বিশ্লেষণ করা যায়।
ক) যে কোন ইন্দ্রিয় অনুভবের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়-উপাত্ত সমূহ কাল-পরিচ্ছেদ ধারণ করেই অনুভবের বিষয়ে পরিণত হয়। অনুভব কাল পরিচ্ছেদ ধারণ করেনি অথচ অনুভবের বিষয় হয়েছে- এমন সম্ভব। অর্থাৎ যখনই আমরা ইন্দ্রিয় অনুভবের মাধ্যমে কোন কিছু প্রত্যক্ষ করি তখনই আমাদের ‘এখন’, ‘তখন’ ইত্যাদি বোধ হয়। এরকম কালবোধ ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে অপরিহার্য। সুতরাং কাল অপরিহার্য এবং সেইহেতু পূর্বত:সিদ্ধ।
খ) আমরা শূন্যকালের কথা ভাবতে পারি, কিন্তু কালশূন্য আভাসের কথা ভাবতে পারি না। আভাস বা অনুভবের বিষয় কালশূন্য – এমন ভাবা যায় না। কাজেই কাল অপরিহার্য।
তৃতীয় যুক্তি:
কালিক সম্বন্ধ বিষয়ক সুনিশ্চিত অপরিহার্য নিয়ম বা কাল-বিষয়ক স্বতঃসিদ্ধগুলির সম্ভবপরতা কালের পূর্বত:সিদ্ধ অপরিহার্যতার উপর প্রতিষ্টিত। যেমন, কালের একটিই মাত্রা আছে, বিভিন্ন কাল যুগপৎ নয়, কেবল আনুপূর্বিক হতে পারে। এসব নিয়ম অভিজ্ঞতা থেকে লব্ধ হতে পারে না। কারণ এসব নিয়ম সার্বিক ও অনিবার্য। আর সার্বিকতা ও অনিবার্যতা ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের মাধ্যমে লব্ধ হতে পারে না। কাল পূর্বত:সিদ্ধ না হলে কাল বিষয়ক নিয়মগুলি পূর্বত:সিদ্ধ হতে পারে না। সুতরাং কাল পূর্বত:সিদ্ধ।
চতুর্থ যুক্তিঃ
কাল যৌক্তিক প্রত্যয় নয়, কাল ইন্দ্রিয় অনুভবের বিশুদ্ধ আকার। খন্ড কাল এক ও অভিন্ন কালের অংশ মাত্র। অখন্ড কাল
অনুভব ছাড়া আর কিছু নয়। তাছাড়া বিভিন্ন খন্ড কাল যুগপৎ হতে পারে না—এই বচনটি সামান্য প্রত্যয় থেকে নিষ্কাশিত হতে পারে না। কারণ বচনটি সংশ্লেষক এবং সংশ্লেষক বচন সামান্য প্রত্যয়ের বিশ্লেষণ লব্ধ হতে পারে না।
প্রসঙ্গত: কান্ট এখানে যে বিপরীত মতের বিরোধিতা করেছেন তা নিম্নরূপ।
কেউ কেউ মনে রন, কাল যুক্তির দ্বারা লব্ধ সামান্য প্রতায়। তাঁদের মতে আমরা প্রথমে খণ্ড কালের জ্ঞান লাভ করি এবং তারপর বিমূর্তকরণের মাধ্যমে কালের সামান্য ধারণা গঠন করি। কিন্তু কান্ট বলেন, এক ও অখণ্ড কালকে পরিচ্ছিন্ন করেই আমরা বিভিন্ন খণ্ড কালের কথা ভাবতে পারি। অখণ্ড কাল যৌক্তিক সামান্য প্রত্যয় নয়, অনুভব। তাছাড়া, কাল যদি সামান্য হতো তাহলে কাল-বিষয়ক বচন সমূহ বিশ্লেষক হতো। কিন্তু কাল-বিষয়ক বচন, যেমন, ‘বিভিন্ন কাল যুগপৎ হতে পারে না’ বিশ্লেষক নয়। সুতরাং কাল সামান্য ধারণা নয়।
পঞ্চম যুক্তি :
কালের অসীমতা একথাই প্রতিপাদন করে যে সীমিত কাল এক অখণ্ড কালকে পরিচ্ছিন্ন করেই সম্ভবপর হয়। আর যা অসীম ও অনন্ত তা সামান্য প্রত্যয় হতে পারে না, তা অনুভব। আধিবিদ্যক ব্যাখ্যায় কাল-বিষয়ক এই যুক্তির অংশ দুটি। প্রথম অংশে কান্ট দেখিয়েছেন –কাল অখণ্ড, অসীম ও অনন্ত। দ্বিতীয় অংশে কান্টের উপজীব্য কাল ‘অসীম ও অনত্ত হওয়ায় কাল সামান্য প্রত্যয় নয়, অনুভব। প্রথম অংশে কান্টের যুক্তি এই যে, আমাদের সীমিত ও খণ্ড কালের জ্ঞান হয়। কিন্তু কোনও না কোনভাবে অসীমের ধারণা না থাকলে
সীমার জ্ঞান হতে পারে না। কাজেই এক ও অখণ্ড, অসীম ও অনন্ত কাল যৌক্তিকভাবে খণ্ডকালের পূর্ববর্তী। আর দ্বিতীয় অংশে কান্টের যুক্তি এই যে, কাল অসীম ও অনস্ত হওয়ায় তা সামান্য প্রত্যয় নয়। একটিসামান্য প্রত্যয় হল বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে বিদ্যমান সাধারণ ধর্ম। কিন্তু কাল সম্পর্কে একথা বলা যায় না যে বিভিন্ন খণ্ড কালের মধ্যে কাল সাধারণ ধর্মরূপে বিদ্যমান। কাল ও কালিকতা এক নয়। কালিকতা বিভিন্ন খণ্ডকালের সাধরণ ধর্ম, কিন্তু কাল তা নয়। এক ও অখণ্ড সমগ্র কালের পূর্বস্বীকৃতি বিভিন্ন খণ্ড কালের জ্ঞানকে সম্ভব করে তোলে। সুতরাং কাল সামান্য প্রত্যয় নয়, অনুভব, বিশুদ্ধ (পূর্বত:সিদ্ধ) অনুভব।
কালের জ্ঞানতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা:
মূলত: জ্ঞানতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে কোনকিছুর ব্যাখ্যাই হলো জ্ঞানতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা। কালকে পূর্বতঃসিদ্ধ অনুভব হিসেবে স্বীকার না করলে পাটীগাণিতিক জ্ঞানের অর্থাৎ কালসংক্রান্ত বচনের সম্ভবপরতা ব্যাখ্যা করা যায় না। কাল সম্পর্কে এই ব্যাখ্যাই হলো জ্ঞানতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা।
কালের জ্ঞানতাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় কান্ট বলেছেন যে, পাটীগণিতের বহু বচন কালসংক্রান্ত বচন। যেমন, “বিভিন্ন কাল যুগপৎ নয়— এই নটি একটি কালসংক্রান্ত স্বতঃসিদ্ধ বচন। এই বচনটি অনিবার্য ও সংশ্লেষক। কালসংক্রান্ত বহু বচনই অনিবার্য ও সংশ্লেষক। অর্থাৎ কালসংক্রান্ত বহু বচন পূর্বত:সিদ্ধ সংশ্লেষক। কান্টের প্রশ্ন – কালসংক্রান্ত পূর্বত:সিদ্ধ সংশ্লেষক জ্ঞানের সম্ভবপরতা কিভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? উত্তরে তিনি বলেছেন যে, কাল পূর্বত সিদ্ধ অনুভব বলেই কালসংক্রান্ত পূর্বত:সিদ্ধ সংশ্লেষক জ্ঞান সম্ভবপর। তাই কাল পূর্বত:সিদ্ধ অনুভব।
Leave a Reply