লক্ষণা
ন্যায়মতে শক্তির মত লক্ষণাও শব্দ বা পদের একটি বৃত্তি (লক্ষণাপি শব্দবৃত্তিঃ)। একটি পদের সঙ্গে একটি পদার্থের সম্বন্ধরূপ বৃত্তি দু’প্রকার : শক্তি ও লক্ষণা। একটি পদ তার শক্তির দ্বারা যেমন একটি পদার্থের বোধক হয়, তেমনি লক্ষণার দ্বারাও একটি পদার্থের বোধক হয়ে থাকে। তবে শক্তি ও লক্ষণার মধ্যে পার্থক্য আছে। একটি পদ শক্তির দ্বারা একটি পদার্থের বোধক হয় সাক্ষাৎভাবে (directly); কিন্তু একটি একটি পদার্থের বোধক হয় পরম্পরাভাবে, অসাক্ষাৎভাবে (indirectly) | লক্ষণার দ্বারা
অন্নভট্ট দীপিকাটীকায় বলেছেন : “শক্যসম্বন্ধোলক্ষণা”। একটি পদের শক্তির দ্বারা যা বোধিত হয় তাই শক্য, সেই শক্যের সঙ্গে সম্বন্ধই লক্ষণা’। গঙ্গা শব্দের শক্যার্থ জলপ্রবাহবিশেষ।
গঙ্গার অতি নিকটে, গঙ্গার তীরে গোপপল্লী আছে—এটি বোঝানর জন্য কেউ বললেন “গঙ্গায়াং ঘোষঃ”। এস্থলে গঙ্গা পদের মুখ্যার্থ বা শক্যার্থ গ্রহণ করলে বাক্যটির অর্থের উপপত্তি হবে না। গঙ্গা পদের শক্যার্থ জলপ্রবাহবিশেষ এবং জলপ্রবাহে গোপপল্লী থাকতে পারে না। “গঙ্গায়াৎ ঘোষঃ” বাক্যটির অর্থের উপপত্তির জন্য গঙ্গা পদের শক্যার্থ পরিত্যাগ করে গঙ্গা পদের লক্ষণা করে তীরকে বুঝতে হবে।
গঙ্গা পদের শক্যার্থ জলপ্রবাহের অতি নিকটে তীর থাকায় গঙ্গা পদের শক্যের সঙ্গে তীরের নৈকট্য সম্বন্ধ আছে এবং এই নৈকট্য সম্বন্ধের দ্বারাই গঙ্গা পদ অসাক্ষাৎভাবে তীরকে বোঝায়।
গঙ্গা পদের শক্যার্থ জলপ্রবাহবিশেষ এবং তার সঙ্গে নৈকট্য সম্বন্ধে যুক্ত তীর লক্ষণার্থ। তাই অন্নংভট্ট দীপিকায় বলেছেন—“শক্যসম্বন্ধো লক্ষণা”।
যাঁরা পদের লক্ষণাবৃত্তি স্বীকার করতে চান না তাঁরা বলেন যে, গঙ্গা পদের লক্ষণা করে তীররূপ অর্থ করার প্রয়োজন নাই। তাঁরা বলেন, গঙ্গা পদের জলপ্রবাহ বিশেষ রূপ অর্থ এবং তীররূপ অর্থ-দুটিই গঙ্গা পদের শক্তির দ্বারা বোধিত। অন্নভট্ট এই মতের বিরোধিতা করে বলেন, শক্তির দ্বারা গঙ্গা পদের জলপ্রবাহ
বিশেষরূপ অর্থ এবং লক্ষণার দ্বারা গঙ্গা পদের তীররূপ অর্থ পাওয়া যায়, যেহেতু জলপ্রবাহবিশেষ ও তীর উভয়ের মধ্যে সামীপ্য সম্বন্ধ আছে। জলপ্রবাহবিশেষ ও তীর—উভয়ই গঙ্গা পদের শক্তি এরূপ বললে গঙ্গা পদকে নানার্থক বলতে হয়। কিন্তু গঙ্গা পদ নানার্থক নয়। গঙ্গা পদকে নানার্থক বলে গঙ্গা পদে নানাশক্তি স্বীকার করলে গৌরব দোষ হবে এবং পদের লক্ষণবৃত্তিকেও অস্বীকার করতে হবে।
অন্নংভট্ট বলেন
অন্নংভট্ট বলেন, নানার্থক পদের ক্ষেত্রে নানাশক্তি স্বীকার্য। যেমন, সৈন্ধব পদ নানার্থক। সৈন্ধব পদের একটি অর্থ লবণ এবং অন্য অর্থ অশ্ব। সৈন্ধব পদের অর্থ লবণ ও অশ্বের মধ্যে কোন সম্বন্ধ না থাকায় লবণ ও অশ্ব উভয়কেই সৈন্ধব পদের শক্তি বলতে হবে। লবণ বা অশ্বের একটিকে সৈন্ধব শব্দের শক্তি ও অপরটিকে লক্ষণার দ্বারা গ্রহণ করা যাবে না, যেহেতু সৈন্ধব পদের ঐ দুটি অর্থ পরস্পর অসম্বদ্ধ।
তাই অন্নংভট্ট সৈন্ধব পদে নানা শক্তি স্বীকার করেছেন। কিন্তু গঙ্গা পদকে নানার্থক বলা অপ্রয়োজনীয়। কেননা গঙ্গা পদের শক্যার্থ জলপ্রবাহবিশেষের সঙ্গে নৈকট্য সম্বন্ধের দ্বারাই গঙ্গা পদের তীর রূপ অর্থ পাওয়া যায়।
গঙ্গা পদের লক্ষণা করে তীর রূপ অর্থ করলে “গঙ্গায়াং ঘোষঃ প্রতিবসতি” বাক্যের অর্থের উপপত্তি হয়ে যায়। সুতরাং শক্তির মত পদের লক্ষণাবৃত্তি অবশ্যস্বীকার্য।
লক্ষণার শ্রেণীবিভাগ
অন্নংভট্ট দীপিকাটীকায় বলেছেন : লক্ষণা তিন প্রকার : (১) জহৎ লক্ষণা, (২) অজহৎ লক্ষণা, (৩) জহৎ-অজহৎ লক্ষণা।
১. জহৎ লক্ষণা
অন্নভট্ট দীপিকাটীকায় বলেছেন : “যত্র বাচ্যার্থস্য অন্বয়াভাবঃ তৎ জহৎ ইতি”।
অর্থাৎ ‘যে লক্ষণায় একটি পদের বাচ্যার্থ বা বাক্যার্থ সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয়, বাক্যের অর্থবোধে ঐ পদের বাচ্যার্থের অন্বয় হয় না, তাই জহৎ লক্ষণা’। যেমন, ‘মঞ্চাঃ ক্রোশস্তি’ অর্থাৎ ‘মগুলি চিৎকার করছে’ বাক্যে মঞ্চ পদের বাচ্যার্থ সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে মঞ্চ পদে লক্ষণা করে মঞ্চে উপবিষ্ট মানুষগুলিকে বুঝতে হবে। মঞ্চে উপবিষ্ট মানুষ’ মঞ্চ পদের লাক্ষণিক অর্থ।
এই লক্ষণা জহৎ লক্ষণা। কেননা এক্ষেত্রে মঞ্চ পদের বাচ্যার্থ অর্থাৎ ‘একটি অচেতন বস্তু’ সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত। মঞ্চ শব্দের বাচ্যার্থ গ্রহণ করলে ‘মঞ্চাঃ ক্রোশস্তি’ বাক্যের অর্থের উপপত্তি হয় না। কেননা একটি অচেতন বস্তু চিৎকার করতে পারে না। মঞ্চ পদে লক্ষণা করে ‘মঞ্চে উপবিষ্ট মানুষগুলি’ এরূপ অর্থ করলে ‘মঞ্চাঃ ক্রোশন্তি’ বাক্যের অর্থের উপপত্তি হয়ে যায়। এই লক্ষণা জহৎ লক্ষণা।
২. অজহৎ লক্ষণা
অম্লংভট্ট দীপিকায় বলেছেন : “যত্র বাচ্যার্থস্য অপি অন্বয়ঃ তত্র অজহৎ ইতি”। অর্থাৎ “যে লক্ষণায় একটি পদের বাচ্যার্থ বা মুখ্যার্থ সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয় না, বাক্যের অর্থবোধে বাচ্যার্থেরও অন্বয় হয়, তাই অজহৎ লক্ষণা”। অন্নংভট্ট অজহৎ লক্ষণার দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে ‘ছত্রিণো গচ্ছত্তি’ বাক্যটি উল্লেখ করেছেন। একদল লোক যাদের অধিকাংশ ছত্রধারী, কয়েকজন ছত্রহীন—এমন জনসমষ্টিকে বোঝানর জন্য বলা হল ‘ছত্রিণো গচ্ছত্তি’। ‘ছত্রধারীরা যাচ্ছে’ বাক্যে জনসমষ্টির মধ্যে যারা ছত্রধারী তাদেরকে যেমন বোঝান হয়েছে, তেমনি যারা ছত্রহীন তাদেরও বোঝান হয়েছে। কিন্তু ছত্রী পদ সাক্ষাৎ বা মুখ্য অর্থে কেবল ছত্রধারীকেই বোঝায়, যারা ছত্রহীন তাদেরকে বোঝায় না। সুতরাং ছত্রিণো গচ্ছত্তি’ বাক্যের অর্থের উপপত্তির জন্য ছত্রী পদে লক্ষণা করে ছত্রধারী ও ছত্রহীন সকলকেই বুঝতে হবে। এই লক্ষণা অজহৎ লক্ষণা, যেহেতু বাক্যার্থবোধে ছত্রী পদের বাচ্যার্থেরও অন্বয় হয়েছে।
৩. জহৎ-অজহৎ লক্ষণা
অন্নংভট্ট দীপিকাটীকায় বলেছেন : “যত্র বাচ্যৈকদেশত্যাগেন একদেশ অন্বয়ঃ তত্ৰ জহৎ অজহৎ ইতি”। অর্থাৎ ‘যে লক্ষণায় পদের বাচ্যার্থ বা শক্যার্থের একাংশ পরিত্যক্ত হয় এবং একাংশ গৃহীত হয় তাকে জহৎ-অজহৎ লক্ষণা বলে’। এই লক্ষণার দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে অন্নংভট্ট উপনিষদের ‘তত্ত্বমসি’ বাক্যটি উল্লেখ করেছেন এবং অদ্বৈতবাদীকে অনুসরণ করে তার ব্যাখ্যা করেছেন। ‘তত্ত্বমসি’ বাক্যে ‘তৎ’ পদের দ্বারা নির্গুণ ব্রহ্ম এবং ‘তুম’ পদের দ্বারা জীবাত্মাকে নির্দেশ করা হয়েছে।
অদ্বৈতবাদীর মতে, এই বাক্যে বলা হয়েছে –তৎ ও ত্বম্ অভিন্ন। তৎ ও ত্বম্-এর অভিন্নত্ব প্রতিপাদনের জন্য অদ্বৈতবাদী তৎ ও ত্বম্ পদে লক্ষণা করেছেন। কেননা সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান ব্রহ্ম এবং অল্পজ্ঞ, অল্পশক্তিমান জীব অভিন্ন হতে পারে না। তাই তৎ ও ত্বম্-এর অভেদ প্রতিপাদনের জন্য অদ্বৈতবাদী উক্ত অর্থ পরিত্যাগ করে ‘তৎ’ পদের দ্বারা ব্রহ্মের স্বরূপ চৈতন্যকে এবং হুম্ পদের দ্বারা জীবের স্বরূপ চৈতন্যকে বুঝিয়েছেন।
সর্বজ্ঞত্ব ও অল্পজ্ঞত্ব, সর্বশক্তিমত্তা ও অল্পশক্তিমত্তা পরস্পর বিরুদ্ধ, কিন্তু চৈতন্য অংশে তৎ ও ত্বম্ অভিন্ন। এক্ষেত্রে তৎ ও তুম্ পদের বাচ্যার্থের একাংশ পরিত্যক্ত হয়েছে ও একাংশ বাক্যার্থে অন্বিত হয়েছে। এরূপ লক্ষণা জহৎ-অজহৎ লক্ষণা। এখানে উল্লেখযোগ্য যে উপনিষদের ‘তত্ত্বমসি’ বাক্যটির অদ্বৈতবাদী ব্যাখ্যা ন্যায়
বৈশেষিক দার্শনিকদের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলেও অন্নংভট্ট জহৎ-অজহৎ লক্ষণার
দৃষ্টান্ত দেওয়ার জন্যই ‘তত্ত্বমসি’ বাক্যের অদ্বৈতবাদী ব্যাখ্যার উল্লেখ করায় কোন
অসঙ্গতি হয়েছে বলে মনে হয় না।
Leave a Reply