এ্যারিস্টটল ও অধিবিদ্যা প্রসঙ্গ:
এ্যারিস্টটলের অধিবিদ্যা বলতে আমরা আজকাল যা বুঝে থাকি তাঁর পূর্বে তার এই নাম ছিল না। এ্যারিস্টল এই শাস্ত্রকে বোঝাতে যে নামটি ব্যবহার করতেন তা হলো “First Philosophy’। অধিবিদ্যাকে First Philosophy বলার কারণও বিশ্লেষণ করেছেন এ্যারিষ্টটল। এই শাস্ত্রে প্রথম ও প্রধান সূত্রসকল আলোচ্য। এই শিরোনামে একখানি সুবিশাল গ্রন্থও রচনা করেছিলেন এ্যরিস্টটল। ওই গ্রন্থে পরম সত্তার স্বরূপ বা প্রকৃতি নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন। অবশ্য ওই গ্রন্থে প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্ব বিষয়ক মতবাদ সমূহও অন্তর্ভূক্ত। ‘অধিবিদ্যা’ (‘Metaphysics) নামটি Andronicus -এর দেওয়া। Andronicus এ্যারিস্টটলের সকল রচনাকে সুশৃঙ্খলিত ও সুবিন্যস্ত করেন। আর একাজ তিনি করেছিলেন খ্রীস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর মধ্যভাগে।
Andronicus কর্তৃক প্রদত্ত এ্যারিস্টটল কৃত First hilosophy -এর একটা বিবরণও পাওয়া যায়। ওই বিবরণ থেকে জানা যায় যে, First Philosophy এমন কতকগুলি নীতি বা সূত্রের সমাহার যা পদার্থবিদ্যার পরবর্ত্তী বা অতীত (in Greek to metata physica)।
তিনি এ্যারিস্টটলের গ্রন্থগারে পদার্থবিদ্যার গ্রন্থের পরেই অধিবিদ্যার গ্রন্থ সনাক্ত করেছিলেন। কালক্রমে ‘অধিবিদ্যা’ পদটির ব্যবহার চালু হয়। তখন থেকে এরকম ধারণাও গড়ে ওঠে যে, যে শাস্ত্রে জড়াতীত ঘটনা বা বিষয়ের আলোচনা থাকবে তাকে অধিবিদ্যক স্বভাব রূপেই বুঝতে হবে। আরও পরবর্তী কালে অধিবিদ্যার বিষয়বস্তু একটি সুনির্দিষ্ট রূপ লাভ করে, অধিবিদ্যা দর্শনের একটি সুনির্দিষ্ট শাখা হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে।
দর্শনের এই শাখার নিম্নোক্ত দু’রকম বিষয়বস্তুর কথা বলা হয় :
- (এক) পরম সত্তা ও সত্তার স্বরূপ, জ্ঞানতত্ত্ব ও ঈশ্বরস্বরূপ
এবং
- (দুই) ইন্দ্ৰিয়াতীত জগৎ বা আপ্রাকৃত জগৎ।
প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকেরা পরিবর্তন ও নিত্যতাকে পরমসত্তার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য বলে মনে করেন। কিন্তু যদি কোন বস্তু স্থায়ী সত্য হয় তবে তার পক্ষে পরিবর্তন কিভাবে সম্ভব? অপর পক্ষে, পরম সত্তা অপরিবর্তনশীল হলে তার বৃদ্ধি, বিকাশ, পরিবর্তন ইত্যাদি কিভাবে সম্ভব? প্রাকৃতিক বিধানেই পরম সত্তা নিত্য ও অপরিবর্তনশীল হলে আমরা কিভাবে পরিবর্তন ও গতিকে ব্যাখ্যা করব? আবার প্রাকৃতিক বিধান সকল গতি ও পরিবর্তনের কারণ হলে ওই গতির মূলে কোন পরম, নিত্য, অপরিবর্তনীয় সত্তা মানা চলে কি? এ্যারিস্টটল তাঁর “First Philosophy” তে এই সকল প্রশ্নের আলোচনাই করেছেন।
যাইহোক, এ্যারিস্টটল যদিও “First Philosophy” কে জগতের সর্বপ্রথম, সর্বোচ্চ ও সর্বব্যাপক নীতিসূত্র বিষয়ক শাস্ত্র বলেছেন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের অপরাপর শাখাকে এই শাখার অধীন গণ্য করার কথা বলেছেন তবুও তাদের মূল্যের ঘাটতি বা কমতির কথা বলেন নি তিনি। একথা ঠিক যে জ্ঞান বিজ্ঞানের অপরাপর শাখা অধিবিদ্যার অধীন। কিন্তু একথার অর্থ এই নয় যে, তারা মূল্যের বিচারে নিকৃষ্টতর।
তাদের তুচ্ছতা যৌক্তিক ক্রম বা পর্যায় বিচারে। তারা অধিবিদ্যার তুলনায় কম ব্যাপক নীতি বা সূত্র নিয়ে আলোচনা করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, উদ্ভিদ বিজ্ঞানের নিয়ম সমূহ কেবল উদ্ভিদের জগতেই প্রযোজ্য, প্রাণী বিজ্ঞানের নিয়ম সমূহ কেবল প্রাণী জগতেই প্রযোজ্য। কিন্তু অধিবিদ্যার নিয়ম বা সূত্র সমূহ সত্তামাত্রের প্রতি প্রযোজ্য অর্থাৎ যে কোন বিষয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
Leave a Reply