বেদ পৌরুষেয় : একটি বিতর্ক

Spread the love

বেদ ঈশ্বরের উক্তি বা ঈশ্বরের বাক্য।

নৈয়ায়িকেরা বৈদিক বাক্য মাত্রকেই ঈশ্বরের বাক্য বলে স্বীকার করেন। অনুংভট্ট দীপিকাটীকায় এই মতের বিরুদ্ধে মীমাংসকদের আপত্তি উল্লেখ করে খণ্ডন করেছেন। মীমাংসকেরা বলেন, বেদ অনাদি, তাই নিত্য। বেদ নিত্য বলে বেদকে ঈশ্বরের বাক্য

বলা যায় না। অম্লংভট্ট বলেন, মীমাংসকদের যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা বেদ, মহাভারত প্রভৃতি গ্রন্থের মত কতকগুলি বাক্যের সমষ্টি। সুতরাং মহাভারত প্রভৃতি গ্রন্থের মত বেদেরও “কোন রচয়িতা স্বীকার্য। এরূপ অনুমানের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, বেদ পৌরুষেয় (“ব্দের

পৌরুষেয়ঃ বাক্যসমূহত্বাৎ ভারতাদিবৎ”)।

মীমাংসা মতে, এই অনুমানের দ্বারা বেদের পৌরুষেয়ত্ব সিদ্ধ হয় না। কেননা ‘বেদন পৌরুষেয়ঃ বাক্যসমূহত্বাৎ’ এই অনুমানে স্মৰ্যমানকর্তৃকত্ব উপাধি হয়। স্মর্ধমানকর্তৃকত্ব শব্দের অর্থ হল যে বাক্যের কর্তাকে পরম্পরাক্রমে বা স্মরণের দ্বারা জানা যায়। যা সাধ্যের ব্যাপক ও হেতুর অব্যাপক তাই উপাধি। সাধ্য পৌরুষেয়ত্ব যেখানে যেখানে থাকে সেখানে সেখানে স্মর্যমানকর্তৃকত্ব থাকে। পরম্পরাক্রমে জানা যায় যে, মহাভারত মহর্ষি কৃষদ্বৈপায়ন রচিত। কিন্তু বাক্য হলেই তা স্মর্যমানকর্তৃকত্ব হবে তা বলা যায় না। বেদ বাক্যাত্মক, কিন্তু তার কর্তাকে পরম্পরাক্রমে জানা যায় না। তাই স্মর্যমানকর্তৃকত্ব সাধ্য পৌরুষেয়ত্বের ব্যাপক ও বাক্যত্ব হেতুর অব্যাপক বলে উক্ত অনুমানে উপাধি হয়।

অন্নংভট্ট দীপিকাটীকায় বলেন—

স্মর্যমানকর্তৃকত্বকে উপাধি বলা যায় না। স্মর্যমান: কর্তৃকত্ব সাধ্য পৌরুষেয়ত্বের ব্যাপক হলেও বাক্যত্ব হেতুর অব্যাপক হয় না, তা হেতুর ব্যাপকই হয়। কেননা মহর্ষি গৌতমাদির শিষ্যপরম্পরা থেকে জানা

যায় যে, গৌতম প্রভৃতি ঋষিগণ তাঁদের সমাধি হতে সর্বজ্ঞতার দ্বারা উপলব্ধি করেছিলেন যে, বেদ ঈশ্বর রচিত।

তাছাড়া ‘তস্মাৎ তপঃ তেপানাৎ ত্রয়ো বেদা অজায়ও’ অর্থাৎ ‘বিশেষ তপস্যারফলে (তেপানাৎ) তিন বেদ উৎপন্ন হয়েছিল এই শ্রুতির দ্বারাও বেদ অনাদি বা নিত্য নয় তা জানা যায় বলে বেদ পৌরুষেয়, একথা প্রমাণিত হয়। মীমাংসকেরা বলেন,

বেদের উৎপত্তি হয়েছে, অর্থাৎ বেদ অনিত্য, তা বলা যায় না। কেননা বর্ণ অনিত্য হতে পারে না। বর্ণ নিত্য, যেহেতু ‘এই সেই গকার’ এরূপ প্রত্যভিজ্ঞা হয়।

উক্ত প্রত্যভিজ্ঞা থেকে গ-কারের নিত্যত্ব সিদ্ধ হয় বলে বর্ণমাত্রের নিত্যত্ব সিদ্ধ হয়।

সুতরাং বাক্যাত্মক বেদের অপৌরুষেয়ত্ব বা নিত্যত্বই সিদ্ধ হয়। এর উত্তরে অম্লংভট্ট বলেন—বর্ণ নিত্য হতে পারে না। ‘গ-কার উৎপন্ন হল’, ‘গ কার বিনষ্ট হল’ আমাদের এরূপ প্রতীতি থেকে বর্ণের অনিত্যত্বই সিদ্ধ হয়। এই সেই কার’ এরূপ প্রত্যভিজ্ঞা

থেকে দুটি গকার অভিন্ন, তা সিদ্ধ হয় না। দুটি গকার সমজাতীয়, তাই সিদ্ধ হয়। যেমন, ‘এই সেই দীপজ্বালা’ এই প্রতীতির দ্বারা প্রদীপশিখার সজাতীয়ত্বই সিদ্ধ হয়।

অন্নংভট্ট বেদের নিত্যত্ব খণ্ডনে আরও বলেন—

বাক্য কতকগুলি পদের সমষ্টিমাত্র নয়। বাক্য হল বিশেষ রচনাক্রম বা আনুপূর্বী বিশিষ্ট পদের সমষ্টি। অন্নংভট্ট বলেন, বর্ণ নিত্য হলেও আনুপূর্বীবিশিষ্ট বাক্য নিত্য হতে পারে না।

যে বিশেষ রচনাক্রমে সুসজ্জিত করলে পদসমূহ বাক্য হয়, সেই রচনাক্রম অনিত্যই হয় বলে বাক্যও অনিত্য হয়। সুতরাং ‘বেদ ঈশ্বর রচিত’, অর্থাৎ বেদ পৌরুষেয়, তা স্বীকার্য।

অন্নংভট্ট আরও বলেন—মনু প্রভৃতি প্রণীত স্মৃতি বা ধর্মশাস্ত্র বেদমূলক বলে প্রমাণ হয়। একথা ঠিক যে, মনু প্রভৃতির স্মৃতিতে উল্লিখিত অনেক বাক্য বর্তমানকালীন বেদে পাওয়া যায় না। অনধ্যয়ন বশত বা গুরুশিষ্য পরম্পরার অভাব বশত বেদের কোন কোন শাখা বিলুপ্ত হয়েছে, সেই বিলুপ্ত বেদ শাখায় মনু প্রভৃতির ধর্মশাস্ত্রে উল্লিখিত বাক্যসমূহ ছিল, তা স্বীকার করতে হয়। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, বাক্যাত্মক বেদ নিত্য হতে পারে না; যা নিত্য তার বিলুপ্তি সম্ভব নয়।

মীমাংসকেরা বলেন—বেদের কোন কোন শাখা বিলুপ্ত হয়েছে তা কল্পনা করা অসম্ভব, যেহেতু এমন কিছু পরিবার দেখা যায় যেখানে পরম্পরাক্রমে নিরবচ্ছিন্নভাবে বেদ অধ্যয়ন করা হয়। সুতরাং একথা বলা অযৌক্তিক যে, স্মৃতির উৎসরূপে পরিগণিত কোন কোন বৈদিক বাক্য মূল শাখা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কালক্রমে বিলুপ্ত হয়েছে। সুতরাং একথা স্বীকার্য যে, বেদ, যা নিত্য ও অনুমেয়, তাই স্মৃতির মূল।

অন্নভট্ট দীপিকাটীকায় এই মত খণ্ডন করেছেন। তিনি বলেন—বৈদিক বাক্য নিত্য ও অনুমেয় হলে ঐ বাক্যস্থিত বর্ণের বিশেষ রচনাক্রমের (আনুপূর্বী) জ্ঞান হবে না। বর্ণসমূহকে বিশেষভাবে সুসজ্জিত করার ক্রম বা আনুপূর্বীর জ্ঞান না হলে বৈদিক

বাক্যের জ্ঞান হতে পারে না এবং ঐ জ্ঞানের অভাবে বৈদিক বাক্য হতে শাব্দজ্ঞান হবে না। সুতরাং নিত্য ও অনুমেয় বৈদিক বাক্য স্মৃতি বা ধর্মশাস্ত্রের বাক্যসমূহের মূল হতে পারে না।।

About Surajit Sajjan 59 Articles
Surajit Sajjan M.A B.Ed Assistant Teacher (HS School)

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*